শিতাংশু ভৌমিক অঙ্কুর,ফরিদপুর।
গদ্যকার বেলায়াত হোসেন মামুনের ভাষায়, “কোনো মানুষ যখন তাঁর জীবনকর্ম অসমাপ্ত রেখে প্রয়াত হন, তখনই আমাদের দীর্ঘশ্বাস ঘন হয়ে আসে। আমরা তাঁকে বলি অকালপ্রয়াত। কিন্তু কোনো মানুষ যদি একটি জাতির প্রত্যাশার স্মারক হয়ে পদক্ষেপ ফেলেন, তখন তাঁর অকালপ্রয়াণ হলে তা কেবল দীর্ঘশ্বাসে শেষ হয় না, তা হয়ে ওঠে হাহাকার ” বাংলা চলচ্চিত্রে আলোর মতো সম্ভবনাময় নির্মাতা তারেক মাসুদ ছিলেন এমনই একজন সদ্য ফুটন্ত পদ্ম ফুল।
২০১১ সালের ১৩ ই আগস্ট পাবনার ইছামতী নদীর তীরে ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশন দেখে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বাংলা সিনেমা ও বাংলার লোকসংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা নন্দিত পরিচালক তারেক মাসুদ।
তারেক মাসুদকে একাধারে সিনেমার কারিগর এবং ফেরিওয়ালা বললে ভুল হবেনা মোটেই। জীবনের রং আর স্বাদ ছেনে সিনেমা বানাতেন। তারপর সাদর আগ্রহ নিয়ে সেই ছবি মানুষকে দেখাতেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও’প্রান্তে, কখনোবা সীমানা ছাড়িয়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প তখন মৃতপ্রায়। সিনেমাপাগল এক তরুণ তার সিনেমার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। বাণিজ্যিক ছবির দাপুটে বাজার, রুগ্ন সমাজ, অর্থাভাব কিংবা অসহযোগী প্রশাসন- কোনোকিছুই তার স্বপ্নকে থামাতে পারেনি। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে মানুষটি চেয়েছিলেন এ দেশের চলচ্চিত্র আক্ষরিক অর্থেই শিল্প হয়ে উঠবে। সেই শিল্পের ছোঁয়া লাগবে দেশের তরুণ-বৃদ্ধ সবার হৃদয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র শিল্প ও সংস্কৃতিই পারে মানুষের আত্মার মুক্তি ঘটাতে ।
১৯৯৫ সালের তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তির গান প্রকাশিত হয়।
এটি ছিলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেয়ার লেভিনের ক্যামেরা ধারণ করা ভিডিও চিত্র যেখানে একদল সঙ্গীত শিল্পী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভারতে বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করে তুলেন।
ততকালীন সময়ের বাংলাদেশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে শাহবাগের জাতীয় গ্রন্থাগারের পাবলিক অডিটোরিয়ামে সিনেমা টি দেখেন।
তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালে বর্তমান ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মাওলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধের পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর আইএ পাশ করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে তিনি তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৮০’র দশকে তারেক মাসুদের পরিচয় হয় ক্যাথরিন মাসুদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ ১৯৮৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের আমেরিকার বাড়ি ছিল স্ট্যাটান আইল্যান্ডে।১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকায় নিয়মিত বসবাস শুরু করেন। ক্যাথরিন এবং তারেক মিলে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন যার নাম অডিওভিশন। ক্যাথরিন, তারেক মাসুদের সাথে অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণে অংশ নেন। তিনি চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন তারেক মাসুদের সাথে। তিনি মাটির ময়না চলচ্চিত্রের সহ-লেখক ছিলেন। ক্যাথরিন একজন চিত্রশিল্পী এবং চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ দম্পতির সন্তান বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ।
তারেক মাসুদকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যার কথা সবচেয়ে বেশি শুনতে হয়েছে বা তারেক মাসুদ যার কাছে বেশি কৃজ্ঞতা শিকার করেছেন তিনি বাংলা সাহিত্য-শিল্পে ইতিহাসের কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মনন ও মনীষাপূর্ণ এই লেখক ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে বিষয়টিকে সবচেয়ে গভীরে নিয়ে গেছেন। বোধ করা যায়, তারেক মাসুদ এই আহমদ ছফার সান্নিধ্যে এসেই শেখ মোহাম্মদ (এসএম) সুলতানের ওপর ‘আদম সুরত’ প্রামাণ্য চিত্র তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এটা এতটাই প্রকাশ্য যে, বিষয়টি তাঁর রচনাসমগ্রের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করতে ছাড়েন নি প্রকাশক : ‘নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এবং নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না। তারেক মাসুদের জীবনে আরেকজনের সান্নিধ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, অগ্রজ চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। বাংলা চলচ্চিত্র যে কজন কারিগরের হাতে চিন্তাসমৃদ্ধ ও নান্দনিক হতে পেরেছে, এর মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর সান্নিধ্যেই নিজের চিন্তা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন তারেক মাসুদ। ততদিনে (৮০-এর দশকে) তিনি নিজস্ব চলচ্চিত্রের ভাষা খুঁজে পেয়েছেন। এটাকে আহমদ ছফা থেকে আলমগীর কবিরে ‘উন্নিত’ হওয়া বলা যায়। অন্তত নিজের কক্ষ পথে যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ কাল বলা যায়।
তারেক মাসুদের নির্মাণের দিকে তাকালেও বুঝা যায় । তার প্রথম প্রামাণ্য চিত্র: আদম সুরত (১৯৮৯) ও মুক্তির গান (১৯৯৯); পূণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র: মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও রানওয়ে (২০১০)।
তারেক মাসুদ নির্মিত “মাটির ময়না” প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এডিবনার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো উৎসবে মাটির ময়না প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশি ২০০২ সালে মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করে। ২০০৩ সালে করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
এই যে তারেক মাসুদের সৃজনশীল চিন্তা ও নন্দিত শিল্প সিনেমার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে তার পাশের যে মানুষটি সবসময় সব কাজে থেকেছেন তিনি তার সহধর্মিণী ভিনদেশি সংস্কৃতির মেয়ে ক্যাথরিন মাসুদ, যে আজ বাংলা সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের অংশ হয়ে উঠেছেন তার কর্ম ও পরিশ্রম দিয়ে।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply